শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৫ পূর্বাহ্ন
যেহেতু কথাটা শুনে চমকে উঠার মতোই, তাই হয়তো আপনিও চমকে উঠেছেন কিন্তু ঘটনা একদম সত্য। বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম এমনকি রাজশাহীতেও এক সময়ে প্রায় শ’দুয়েকের মতো ইহুদী পরিবার বাস করতেন। ওরা এদেশে এসেছিলো ১৭ শতকে মুঘল আমলে মূলতঃ মসলিন কাপড়ের ব্যবসা করতে। তারা এদেশে আসার পর শুরুতেই তেমন ভাবে বসতি স্থাপন না করলেও পরবর্তীতে ইংরেজ আমলের শুরু থেকেই এই দেশে তারা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন এবং ব্যবসা-বানিজ্য শুরু করে।
‘সালাম কাহা’ একজন ইরাকী বোগদাদি ইহুদীর নাম। জানা যায়, তিনি এই দেশে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন ১৭৯৮ সালে এবং তার ছিলো বিশাল কাপড়ের ব্যবসা। সে তার পরিবার পরিজন নিয়ে এদেশে বসবাস করতেন, তার একটি মেয়েকেও এখানে থেকে বিয়ে দেন।
রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র পুরানা পল্টন মোড়ের একটি প্রাচীন আমলের দোতলা ভবন অনেক পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও প্রায় কেউই এর আসল ইতিহাস জানেন না। ভবনটির গায়ে একটি শ্বেতপাথরে লেখা আছে ‘ফ্রিম্যাসন্স হল-১৯১০’। অনেক ঘাঁটাঘাঁটির পর এই ‘ফ্রিম্যাসন্স’ কথাটি সম্পর্কে জানা যায় জন রিচার্ডসন বেনেটের লেখা এ-সংক্রান্ত একটি বই থেকে। সে সূত্রে জানা যায়, ‘ফ্রিম্যাসন্স’ আসলে ইহুদিদের একটি ক্লাবের নাম। জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ নামে তাদের অনেক ক্লাব রয়েছে। সেখানে তারা অবসরে মিলিত হয়ে আড্ডা, খেলাধুলা, ধর্মীয় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে। ঢাকার পুরানা পল্টনের উল্লেখিত ভবনটিও একদা এডেন ইহুদী ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যা ছিল ঢাকাবাসীর কাছে একটি রহস্যজনক ক্লাব। ইহুদী সম্প্রদায়ের লোকজন ছাড়া ক্লাবটিতে কেউ প্রবেশ করতে পারতো না।
এবিষয়ে পুরানা পল্টনের প্রবীণ বাসিন্দা আবুল ফিদা চৌধুরীর কাছ থেকে জানা যায়, ‘আজ থেকে ৫০ বছর আগেও পল্টনের এ ক্লাবে ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকজন ভিড় করতো। ক্লাবের ভেতরে চলত তাদের আলাপ-আলোচনা, গোপন বৈঠক, খানাপিনা এবং নাচগান। তবে এসব কিছুই হোতো সতর্কতার সঙ্গে,যাতে করে বাইরে থেকে তাদের কোনো কিছুই জানা যেতো না। যাঁরা এখানে আসতেন তাঁরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেন না। তবে স্থানীয় লোকজনও ইহুদীদের ক্লাব মনে করে সেখানকার আশপাশে ঘেঁষতেন না, পাছে যদি কোনো ঝামেলা হয়। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর আর তাদের পল্টনের এই ফ্রিম্যাসন্স ক্লাবে খুব একটা দেখা যেত না। পরে ক্লাবটি পরিত্যক্ত ঘোষণা হলে সেখানে রমনা তহশিল অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়। জানা যায়, মুসার নির্মিত ইহুদীদের সেই উপাসনালয়টি ১৯৬০ সালের পরে ফ্রিম্যাসন্স ক্লাব হয়। পরবর্তীতে তা পরিত্যক্ত হলে সেখানে রমনা তহশিল অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ভবনটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জানা যায়, ১৭/১৮ দশকের দিকে ধীরে ধীরে প্রায় ৪০০০ এরও অধিক ইহুদী এই দেশে আসেন এবং বিভিন্ন রকমের ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়ে যান তারা। তবে এদের মধ্যে বেশিরভাগই কোলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করতেন। সেই সাথে বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামেও বেশ কিছু ইহুদী পরিবার স্থায়ী ভাবে থাকতে শুরু করেন এবং তারা কাপড়ের ব্যবসার পাশাপাশি মোটর গাড়ি, বাই সাইকেল, মুক্তা, গাঁজা, আফিমের ব্যবসায় জড়িত হয়ে অল্পদিনেই ধনাঢ্য পরিবারে পরিবর্তিত হয়ে যান।
তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা গেছে মূলতঃ দুই ধরনের ইহুদীরা বাংলাদেশে আসে: বোগদাদি ইহুদী এবং বনী ইস্রায়েলি ইহুদী।
বোগদাদি ইহুদীদের নামের সাথে এই দেশের সাধারণ মানুষের নাম, চেহেরা ও সংস্কৃতির মিল থাকার কারণে তারা খুব সহজে মিশে গিয়েছিলো এই দেশের মানুষের সাথে। এমনকি তারা বিয়ে সাদীও করতো এখানেই। অন্যদিকে বনী ইস্রায়েলী ইহুদীরা খৃষ্টান পরিচয়ে থাকতো।
পরবর্তীতে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের পরেও তারা এই দেশের সাধারণ মানুষের সাথে থাকতো। আর তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ব্যবসা বানিজ্যে জড়িত ছিলেন বটে, তবে অনেকেই আবার ঢাকার নামী দামী স্কুল, কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশায় ছিলেন। যেমন: আলেক্স এয়ারেন্সন নামের ইহুদী লোকটি ছিলেন ঢাকার নবাব খাজা নাজিমউদ্দীন এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু। আর উনি ইহুদী হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজদের এই দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য জার্মাণদের পক্ষ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। পেশাগত ভাবে উনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক।
এছাড়াও এই দেশের টেলিভিশন স্থাপনা ও সম্প্রচারে ইহুদীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বলে জানা যায়। “মর্ডিকাই হাইম কোহেন” নামক একজন ইহুদীর নাম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৪ সালে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের, আর শুরুর দিকে বিটিভিতে বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু এ তিন ভাষায় সংবাদ পাঠ করা হোতো। তখন টেলিভিশনের সাদা-কালো পর্দায় সুদর্শন এক ব্যক্তি তিন ভাষাতেই খবর পাঠ করতেন, যার নাম ছিল মর্ডিকাই হাইম কোহেন। বলা যায়, এ মর্ডিকাই ছিলেন বাংলাদেশের ইহুদীদের মধ্যে সর্বশেষ সুপরিচিত ব্যক্তি যিনি ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে যান।
১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেলেও ২০১৫ সালে ৭৪ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কলকাতায় বাস করতেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে বিটিভির সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজেকে বরাবরই বারেন্দ্র বা বরেন্দ্র অঞ্চলের ইহুদী হিসেবে দাবি করে এসেছেন তিনি।
তবে কোহেনের পূর্বপুরুষরা বাগদাদি ইহুদী ছিলেন বলে জানা যায়। এছাড়াও বাংলায় বাগদাদি ইহুদী সম্প্রদায়ের উৎস খুঁজতে গেলে সবার আগে উঠে আসে শ্যালোম কোহেনের (১৭৮২-১৮৩৬) নাম। সুরাট থেকে ১৭৯৮ সালে কলকাতায় এসে থিতু হন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের মতো পূর্ববঙ্গেও ইহুদী সম্প্রদায়ের পত্তনের সঙ্গে তার নাম জড়িত। মসলিন ও রেশমের বস্ত্র নিয়ে ব্যবসা করার জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পাঠিয়েছিলেন তিনি।
১৮১৭ সালে কোহেলের বড় মেয়ে লুনাহর সঙ্গে মোজেস ডুয়েক নামে এক ব্যবসায়ীর বিয়ে হয়। ওই দম্পতি ঢাকায় এসে বসবাস করেন পাঁচ বছর। এ সময় তারা এখানে উপাসনার জন্য একটি প্রেয়ার হলও স্থাপন করেন। ১৮২২ সালে পরিবারটি কলকাতায় ফিরে গেলেও এখানকার সঙ্গে সংযোগ পুরোপুরি ছিন্ন করেননি। পরবর্তী সময়ে বাগদাদি ইহুদীরা ঢাকাকে কেন্দ্র করে বস্ত্র, মুক্তা ও গাঁজা আফিমের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন।
ইহুদিদের অনেকেই এ দেশকে ভুলে যেতে পারেননি আজীবন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে মর্ডি কোহেন রাজশাহীর স্মৃতিচারণা করেছেন বারবার। মা ছিলেন কলকাতার ইহুদী। এ সূত্রে সেখানেই জন্ম তার। অন্যদিকে বাবার পরিবার দেড় শতকেরও বেশি সময় ধরে থিতু ছিল রাজশাহীতে। এ কারণে তার বেড়ে ওঠা রাজশাহীতেই। পড়াশোনাও করেছেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। ওই সময় পদ্মার পাড়ে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ানো রাজশাহী শহরে বাবার দোকান বা স্থানীয় বন্ধুদের স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আজীবন।
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পূর্ববঙ্গে ইহুদীবিরোধী মনোভাব বেশ জোরালো হয়ে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৮ সালে সপরিবারে ভারতে চলে যান মর্ডি কোহেন।
উল্লেখ্য যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পীঠস্থান জাতীয় সংসদ ভবনের সঙ্গেও এক ইহুদীর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের সংসদ ভবনটির স্থপতি লুই আই কান ছিলেন একজন পোলিশ-মার্কিন ইহুদী।
১৯৬০ -এর আরব ইস্রায়েলের যুদ্ধের পরপরেই তোপখানা রোডে তাদের একমাত্র সিনাগগ পুড়িয়ে দেওয়া হলে, পরে এদের অনেকেই বিশেষ করে বোগদাদি ইহুদীরা সহায় সম্পদ ফেলে ভয়ে দেশ ত্যাগ করে।
পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ বাঁচাতে সমস্ত ইহুদীরা দেশত্যাগ করেন। একটি তথ্যে জানা যায়, ৭১’-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা বাঙালীর পক্ষে ব্যাপক লবিং করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যও করেছেন বলে জানা গেছে। বলা হয়েছে, এদের লবিং -এর কারনেই ভারত ও ভূটানের পরেই ইস্রায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
ওদিকে বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে এদের অনেকেই যদিও আবার বাংলাদেশে ফেরত আসে কিন্তু তৎকালীন সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে ও তাদের উপাসনালয় ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানালে পরে তারা অধিকাংশরাই বাংলাদেশ ত্যাগে করেন। তবে, ধারণা করা হচ্ছে, অতি সংগোপনে এখনো বাংলাদেশে বেশকিছু ইহুদী পরিবার বসবাস করেন।
(ছবি পরিচিতি: ইহুদিদের একসময়ের সিনাগগ, পরে ১৯৬০ সালের পরে তা ফ্রি ম্যাসন ক্লাব হয়, যা এখন সরকারি দপ্তর হয়।)