শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৯:২৮ অপরাহ্ন
রফিকুল হক শিকদার জাহাঙ্গীর
গাজীপুরের জয়দেবপুর এলাকার সবুজ ওরফে বনি (২৭)। হিন্দু পরিবারের সন্তান হয়েও নিজের পরিচয় দেয় মুসলিম হিসেবে। বিবাহিত হয়েও বলে অবিবাহিত। টিকটকে সেলিব্রিটি সে। রয়েছে ৭০ হাজার লাইক এবং তিন হাজারেরও বেশি ফলোয়ার। নিয়মিত বিভিন্ন ঢংয়ে ভিডিও আপলোড দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। এরপর তার ভিডিওতে সবুজ ওরফে বনি লাইক-কমেন্টস করা মেয়েদের টার্গেট করে পাঠায় মেসেজ। কোনো মেয়ে রিপ্লাই দিলেই যান ফেঁসে! কথপোকথনে এক পর্যায়ে রিপ্লাই দেয়া মেয়ের ফেসবুক, হোয়াটসআপ, মোবাইল নম্বর থেকে শুরু করে সব জায়গায় যুক্ত হয়ে করে বিশ্বাস অর্জন। মেয়েদের জন্মদিনে কুরিয়ার করে পাঠায় বিভিন্ন উপহারসামগ্রী। আন্তরিকতা বাড়লে দেয় প্রেমের প্রস্তাব। এক পর্যায়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ভিডিওকলে আপত্তিকর অবস্থায় কথা বলে সেগুলো নিজের কাছে রেকর্ড করে রেখে দেয়। আবার কোনো কোনো মেয়েকে নিয়ে যায় ঢাকার বাইরে লংড্রাইভে, ঘুরতে গিয়ে বিশেষ মুহূর্তে ভিডিও এবং আপত্তিকর ছবি
ছবি-ভিডিও ধারণ করে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা ■ হুমকি দিয়ে তরুণীদের রাখে বশে
লোকলজ্জার ভয়ে অভিযোগ তা করেন না অনেক ভুক্তভোগী
তুলে রাখে নিজের ফোনে। এরপর সেই ছবি দিয়ে করে ব্ল্যাকমেইল। পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত একটি মামলার অনুসন্ধানে গিয়ে অভিনব এই প্রতারকের সন্ধান পাওয়া যায়। বিভিন্ন নারীর সঙ্গে আপত্তিকর অন্তত ১০টি ভিডিও- ও আসে হাতে। আর সবুজের কাছে প্রতারিত হওয়া অন্তত তিন নারীর সঙ্গে কথাও হয় এই প্রতিবেদকের।
ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সবুজ ওরফে বনি বলে, আসলে যা শুনছেন বিষয়টা এমন নয়। আমি শুধু প্রেম করেছি আর ব্রেকাপ করেছি, আর কিছু না।’ আপত্তিকর অন্তত ১০টি ভিডিও ফুটেজের বিষয়ে সে বলে, এ বিষয়ে আমি
লইফ নষ্ট হয়ে যাবে, মুখ দেখাতে পারবে না! বলে প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ করে সে। হাতে আসা কয়েকটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভিডিওতে অভিযুক্ত সবুজ ওরফে খনি এক এক সময় এক এক নারীর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে। কথা বলার সময় বেশিরভাগ সময়ই সে স্বাভাবিক ছিল না। প্রায় সব ভিডিওতেই বিভিন্ন নারীর সঙ্গে তাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখা যায়। কখনও তা ভিডিওকলে আবার কখনও সরাসরি এক নারীর সঙ্গে তাকে কক্সবাজ একটি হোটেলেও আপত্তিকর অবস্থার দেখা যায়। ভিডিওগুলোর অবস্থা এতই বাজে যে তার বিবরণ লেখা সম্ভব নয়।
ঝর্ণা (ছদ্মনাম) নামের এক ভুক্তভোগী জানান, তাকে প্রেমের জালে ফেলে তার আপত্তিকর ভিডিও ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করে অন্তত আড়াই লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সবুজ ওরফে বনি। এ বিষয়ে গত ২৭ এপ্রিল রাজধানীর ভাটারা থানায় লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন ভুক্তভোগী ওই নারী। অভিযোগে তিনি বলেন, গত জানুয়ারি মাসে আমার ফেসবুক আইডিতে সবুজ নামের ওই ছেলে রিকোয়েস্ট পাঠায়। তখন থেকে তার সঙ্গে আমার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ হয়। পরে ওই ছেলে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আমাকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায় এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তারিখে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও তার মোবাইল ফোনে ধারণ করে রাখে। এরপর চলতি বছরে মার্চ মাসের ৫ তারিখ থেকে বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে সবুজ তার মোবাইল ফোনে ধারণ করে রাখা আমার আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ফেসবুক, টিকটকসহ অন্যান্য ইন্টারনেট মাধ্যমে ভাইরাল করে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে আমার কাছ থেকে সর্বমোট দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর গত এপ্রিলের ২৬ তারিখে রাত অনুমান ১০টায় আমার কাছে ফের টাকা চায়। এ সময় আমি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমার আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ফেসবুক, টিকটিকসহ
অন্যান্য ইন্টারনেট মাধ্যমে ছড়িয়ে দেনা বিষয়টি স্বীকার করে তদন্ত কর্মকর্তা সাব-ইনস্পেক্টর শামিম নয়া শতাব্দীকে বলেন, অভিযোগটা আমরা পেয়েছি। এটা তো সাইবারের বিষয়। আমরা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার সেলে অভিযোগটা পাঠিয়ে দিয়েছি। এটা এখন সাইবার সেল তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। আরেক ভুক্তভোগীর স্বামী বলেন, ‘স্বামী হিসেবে স্ত্রীর এসব বিষয়ে কথা বলা
খুবই কষ্টকর। আসলে আমার স্ত্রীর সঙ্গে তেমন কিছু করতে পারেনি। ওদের টিকটকে একটা গ্রুপের মাধ্যমে কথা হয়। আমি জানতাম না আমার স্ত্রীও
টিকটক ইউস করে। জানার পর আমি আমার স্ত্রীকে কন্ট্রোল করি। এরপরও আমি সবুজের আইডি কিছুদিন ফলোতে রেখেছিলাম। এ সময় ওর আইডিতে
দেখি, এক এক সময় এক এক নারীর সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও আপলোড করছে। ও আসলে একজন পেশাদার প্রতারক। এটাই ওর পেশা। আপনার
স্ত্রীর কাছে থেকে টাকা-পয়সা নিয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ,
আমার স্ত্রী কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছে।
বিস্তারিত জানতে সবুজ ওরফে রনির বোনের নম্বরে ফোন দিলে ফোন রিসিভ করেন সবুজের বোন জোনার স্বামী। উত্তম সাহা নামের ওই ব্যক্তি বলেন, এসব বিষয়ে আমার স্ত্রীর জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ সবুজের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগই নেই।
একই ঘটনা ঘটেছে আরও এক বিশ্ববিদ্যালয় সমমানের শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তিনি বর্তমানে ঢাকার বাইরে পড়াশোনা করছেন। জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই শিক্ষার্থী নয়া শতাব্দীকে বলেন, আসলে এ ঘটনায় আমি পারিবারিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ওই ছেলের সঙ্গে আমার টিকটকে যোগাযোগ হয়। এরপর ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। অনেক দিন কথা বলার পর ও আমাকে প্রথম করে। আমি প্রথমে রাজি হইনি। পরে জোরাজুরি করলে রাজি হই। আমাকে বিভিন্নভাবে ব্রেইনওয়াশ করে। কীভাবে কী হলো বুঝতে পারলাম না। এরপর আমাদের ভিডিও কল রেকর্ড করে রাখে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ।