সুগন্ধি উৎপাদনকারী “আগর” গাছ (agarwood) হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কাঠগুলোর অন্যতম, যার এক কেজি প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ভালো মানের কাঠের দাম এককোটি টাকারও বেশি পর্যন্ত হতে পারে*! ১০০% রপ্তানিমুখী এ কাঠ থেকে বাংলাদেশে উৎপাদিত তৈল/আতর বা liquid resin এর দাম আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে ৮/১০ লাখ টাকা পাওয়া যায়!
সুগন্ধি আগর কাঠ ও আগর তৈল মূলত পাঁচ ভাবে ব্যবহার হয়:-
১/আতর/পারফিউমারি প্রডাক্ট তৈরিতে,
২/দামি কসমেটিক তৈরিতে,
৩/হারবাল ঔষধ তৈরিতে,
৪/সৌখিন ও এন্টিক দ্রব্য হিসাবে, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে,
৫/ধর্মিয় আচার-অনুষ্ঠানে।
তথ্য উপাত্ত বলছে, সারা বিশ্বে আগর প্রডাক্ট এর বাজার বর্তমানে বছরে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি,এবং তা প্রতি বছর ২০% হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তথ্য মতে, গেল বছর বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার আগর পণ্য উৎপাদন হয়েছে, সেই হিসাবে বিশ্ব বাজারে আগর প্রডাক্ট নিয়ে বাংলাদেশের অংশগ্রহন মাত্র ৩০০ ভাগের একভাগ প্রায়! আদতে আগর নিয়ে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ১২ বিলিয়নের অর্ধেক অর্থাৎ ৬ বিলিয়ন না হলেও তিন ভাগের এক ভাগ মানে ৪ বিলিয়ন হতে পারতো বা হওয়া সম্ভব ছিলো!
কিভাবে সম্ভব ছিলো?চলুন তাই এবার আলোচনা করি:–
আগর গাছের আদি উৎস বা উৎপাদন অঞ্চল বাংলাদেশের পূর্ব অংশ ও তৎসংলগ্ন ভারতের ত্রিপুরা,আসাম,মেঘালয়, মিজোরাম অঞ্চল! যদিও আমাদের বন বিভাগের মাননীয় কর্তারা আগর গাছের আদি উৎস হিসাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রেইনফরেস্ট-
কেই নির্দেশ করেন*,
অপর দিকে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ” ইউনিভার্সিটি মালায়া’র” গবেষকেরা বলেন আগর গাছের আদি উৎস হলো পূর্ব ভারতে!
আগর গাছ বিশ্বের সব দেশ বা অঞ্চলে জন্মে না, বর্তমানে “আগর গাছ” উৎপাদনকারী দেশ গুলো হলো বাংলাদেশ,মায়ানমার,থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া,ইন্দোনেশিয়া,কম্বোডিয়া,লাওস,ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্যগুলিতে, যদিও আগর গাছের কিছু কিছু প্রজাতি শ্রীলংকা, চীন,পাপুয়াতেও পাওয়া যায়,এই হলো আগরের উৎপাদন অঞ্চল*।
আর আগরের প্রধান ভোক্তা অঞ্চল হলো আরব রাষ্ট্র গুলো*,সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে আরবীয় বনিকেরা সুগন্ধি আগর কাঠ কিনতে বর্তমান ফেনী জেলা শহরের পার্শ্ববর্তী প্রাচীন বন্দরে (অধুনা লুপ্ত) আসতেন বলে প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ সমূহে উল্লেখ আছে*। বনিকেরা ঐ বন্দরে এসে আগরতলা,সিলেট ও আসামের আগর কাঠ কিনতেন*!
প্রসংগত,কয়েক হাজার বছরের পুরোনো রাজ্য ত্রিপুরা রাজ্যের বর্তমান রাজধানী আগরতলার নামকরন হয়েছিল এই আগর গাছের নাম থেকেই!
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আগর গাছ নিয়ে আরও কিছু তথ্য জেনে নিলে আমার উত্থাপিত বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝাতে সুবিধা হবে।
আগর গাছের প্রজাতি ১৭ টি/কোন কোন বর্ণনায় ১৩টি হলেও বেশ কয়েকটি প্রজাতি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বাণিজ্যিকভাবে বেশি চাষ হওয়া প্রজাতি হলো অ্যাকিউলারিয়া ম্যলাকানসিস প্রজাতি (aquilaria malaccensis), সারা বিশ্বে সুগন্ধি আগর উৎপাদনের মোট ৪৫ থেকে ৫০% এ প্রজাতিটি থেকে আসে, আর এ প্রজাতিটিই আমাদের এ অঞ্চলের আবহাওয়ায় ভালোভাবে জন্মে*!
এ কাঠ খুবই নরম প্রকৃতির, অনেকটা তুলা গাছের কাঠের মত নরম ও সাদা, বহুবর্ষজীবী এ গাছ দেড় দু’শ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, লম্বায় ৭৫ ফুটের অধিক ও ভূমি সমতলে ৭ ফুটের অধিক পর্যন্ত বেড়ে মোটা হতে পারে, এ গাছের ডাল পালা কম হয়,ঘন গাছ-গাছালির ভিতরও দ্যূত বেড়ে উঠে সব গাছকে ছাড়িয়ে সোজা উপরে উঠে যায়,অনেকটা একাশিয়া গাছের মত। আগর গাছে তিন বছর বয়সে প্রথম ফুল আসে।
আগর গাছের পাতা,কাঠ,শিকড়,চামড়া সবই ব্যবহৃত হয়।
পাতা থেকে উৎপাদিত চা/পানীয়,সাধারণ চা এর মত চিনি যুক্ত/চিনি ছাড়া,গরম/ঠান্ডা যেভাবে ইচ্ছা পান করা যায়, সুগন্ধিযুক্ত সর্বোৎকৃষ্ট হারবাল পানীয় হিসাবে এ চা উচ্চমূল্যে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
সব বয়সের পুরুষ ও মহিলার ডায়াবেটিস, রক্তচাপ কিডনি, লিভার সহ শরীরের ইমিউন সিস্টেম ঠিকঠাক রাখতে ও যৌবন/তারুণ্য,রূপ-লাবণ্য ধরে রাখতে, এ সুগন্ধি চা যথেষ্ট কার্যকরী বলে মনে করা হয়,যদিও আমাদের দেশে এ পানীয় এর প্রচলন নেই! তবে আমাদের দেশে এ চা তৈরির যথেষ্ট কাঁচামাল আছে*, একটু চেষ্টা করলে এ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বিশ্ব বাজারে আগর গাছের পাতা থেকে উৎপাদিত চা/পানীয়ের মূল্য সাধারণ চায়ের থেকে অন্তত ৩০/৪০গুন বেশি!
৮/১০ বছর বয়সের একটা আগর গাছ থেকে বছরে ৫/৭ কেজি শুকনো “আগর চা” পাতা সহজেই সংগ্রহ করা যায়,গাছের বয়স তিন বছর হলেই পাতা সংগ্রহ করা যায়।
আগর গাছে জুন মাসে থোকায় থোকায় সাদা রং এর ফুল ফুটে,এ ফুল থেকে মৌমাছিরা উচ্চ ঔষধি গুনসমৃদ্ধ মধু আহরণ করে!
আগর কাঠ মূলত সাদা,গাছের বয়স ২৫/৩৫ বছর হলে এই সাদা কাঠের বিভিন্ন স্থানে এক প্রকার ছত্রাকের সংক্রমণের প্রভাবে প্রাকৃতিকভাবে কালো রং ধারন করা শুরু হয়, আর ঐ কালো রং ধারন করা কাঠই সুগন্ধি আগর কাঠ। উদাহরণ সরূপ: ঐ পর্যায়ে একটা আগর গাছের ওজন যদি হয় ৫০০ কেজি তা থেকে ২০০/৪০০গ্রাম থেকে ২/৪ কেজি কালো বা লাল/হালকা লাল,বাদামি,ধুসর রং এর আগর কাঠ পাওয়া যেতে পারে (রং যত কালো ও ভারি,দাম তত বেশি), যা দামি আতর তৈরির উপাদান হিসাবে মূল্যবান,আর বাকি সাদা কাঠের তেমন কোনো বাজার মূল্য নেই, (সাদা আগর কাঠের কেজিপ্রতি মূল্য গাছের বয়স ভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা হতে পারে,যা থেকে কম দামি সাদা আতর ও আগরবাতি তৈরি হয়)।
কিন্তু প্রতিটি আগর গাছেই প্রাকৃতিকভাবে ছত্রাকে সংক্রমিত হয় না, তাই শতবর্ষজীবী হলেও আমাদের আকাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক কালো কাঠও উৎপাদন হয় না,সাদা’ই থেকে যায়। শতকরা ৫ থেকে ৭টি আগর গাছেই শুধু প্রাকৃতিক ভাবে ছত্রাকে আক্রান্ত হয়,যার কারণে মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সুগন্ধি কালো কাঠ উৎপাদন হয়।
গাছের কান্ড/কাঠে ছত্রাকে আক্রান্ত না হলে যেহেতু সুগন্ধি কালো কাঠ উৎপাদন হয় না, তাই সমস্যা টা এখানেই! আমাদের এ অঞ্চলে আদিমযুগ থেকে আগর গাছ বা কাঠের আদি উৎস হলেও যার কারণে আজ প্রকৃতিক আগর গাছ শুন্য।
আসাম/মেঘালয়/পৌরাণিক ধর্মীয় ভূমি কামরুপকামাক্ষা অঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণ দিকে বর্তমান শেরপুর ময়মনসিংহ টাংগাইল গাজীপুর বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল এবং বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য,মিজোরাম ও তৎসংলগ্ন কুমিল্লা,চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম,কক্সবাজার অঞ্চলের প্রকৃতিতে এক সময়ে প্রচুর আগর গাছ পাওয়া যেত,এ অঞ্চলের আগর কাঠ সংগ্রাহকেরা কালো আগর কাঠের খোঁজে একের পর এক আগর গাছের কাষ্ঠল অংশ কুচি কুচি করে কেঁটে তাতে কালো রং ধারণ করা কাঠের খোঁজ করতো,১০০ টি আগর গাছ কাটলে তার ৫/৭টা তে অল্পস্বল্প কালো আগর কাঠ পেলেও সাদা কাঠ যুক্ত বাকি প্রায় শতটি গাছ মারা পরতো, আর এভাবেই এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক আগর গাছ উজার/শুন্য হয়ে পরে!
যাই হোক,কালো আগর কাঠ সংগ্রহ করে তাতে মশার কয়েলের মত এক প্রান্তে আগুনে পুড়িয়ে দিলে জ্বলতে থাকতো আর সুগন্ধি ধোঁয়া বের হতো, এটাকেই বলা হতো “আগরবাতি”।
পরে তারা দেখলো,এই সুগন্ধি কাঠ’কে পানি সহযোগে সিদ্ধ করলে পানির উপর এক প্রকার সুগন্ধি তৈল ভেসে উঠে,আর ঐ সুগন্ধি তৈলকে বলা হতো “আতর” ! রাজা বাদশা-ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব’রা সহ এলিট শ্রেণীর মানুষ আভিজাত্যের অংশ,চিকিৎসায় ও ধর্মীয় পরিশুদ্ধতায় এ কাঠ ও তৈল ব্যবহার করতো!
সেই আদি যুগ থেকে রাজা-বাদশা নবী-রাসূল সহ সকল ধর্ম ও জাতির ধর্মীয়/আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব’রা সুগন্ধির উৎস হিসাবে এই আগর কাঠের অংশবিশেষ আগুনে জ্বালিয়ে সুগন্ধি ধোঁয়া সৃষ্টির মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে আসছেন।
“আগরবাতি” নামটা এভাবেই এসেছে, এখন বাংলাদেশের বাজারে যে “আগরবাতি” পাওয়া যায় তার প্রায় সব ব্র্যান্ড’ই নকল! ‘স’ মিলের কাঠের গুড়ার সাথে কৃত্রিম সুগন্ধি মিশিয়ে তৈরি।
পবিত্র হাদিস শরিফে এ আগর কাঠকে “ওউদ আল-হিন্দ” (oud al-hind) বা হিন্দুস্তান অঞ্চলে প্রাপ্ত সুগন্ধি কাঠ হিসাবে উল্লেখ আছে, হযরত মুহাম্মদ (স:) নিজে এটা ব্যবহার করতেন, তিনি বলেছেন ওউদ আল-হিন্দ/আগর হলো সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধি ও বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক….., তাই মুসলিমদের কাছে এই সুগন্ধি ব্যবহার করাটা সুন্নত।
অনুরূপভাবে খ্রিস্টান ধর্মীয় গ্রন্থে এ কাঠকে the woods of the gods এবং অ্যালোসউড/ঈগল উড বলা হয়েছে…..
ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এ কাঠকে আগরু/অঘুরু বলা হয়েছে,হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ/পৌরাণিক কাহিনিতে এ কাঠের গুন-গানের ছড়াছড়ি…..
বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের কাছেও এ কাঠ অত্যন্ত পবিত্রতা ও শুদ্ধতার প্রতীক…..,তাই এ গাছ/কাঠকে ধর্ম নিরপেক্ষ গাছও বলা হয়!
আগর গাছে প্রাকৃতিক ভাবে সুগন্ধি কালো কাঠ সৃষ্টি হওয়ার ব্যপারটা অনেকটা ঝিনুক থেকে প্রাকৃতিকভাবে মুক্তা সংগ্রহের মত,একটা প্রাকৃতিক মুক্তা সংগ্রহে যেমন হাজার হাজার ঝিনুক ভেঙে (মেরে) দেখতে হয় যে তাতে মুক্তা হয়েছে কিনা, ঠিক তেমনি শত শত আগর গাছ কেটে/মেরে/উজার করে/ধ্বংস করে কান্ড শাখা প্রশাখা থেকে শুরু করে শিকর পর্যন্ত তার সাদা কাঠকে কুচি কুচি করে কেটে খুঁজে দেখতে হয় যে তাতে সুগন্ধি কালো কাঠ সৃষ্টি হয়েছে কিনা,
আর এভাবেই আগর গাছের প্রাকৃতিক/বন্য পপুলেশন ধ্বংস হয়ে যায়।
সারা বিশ্বে প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত কালো আগর সুগন্ধি কাঠের পরিমাণ খুবই নগণ্য ও তা অতি উচ্চ মূল্যের এবং অতি দুষ্প্রাপ্য!
ঘটনা চক্রে আমেরিকার সাথে ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময় থেকে শুরু হওয়া কৃত্রিম পদ্ধতিতে আগর গাছে ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটিয়ে কালো কাঠ উৎপাদন করা শুরু হয়, ঘটনাটি এইরকম:-
“ভিয়েতনাম লাওস সীমান্তের বনাঞ্চলে প্রচুর আগর গাছ পাওয়া যায়,ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকান বাহিনীর ভয়ে লোকজন জংগলে পালিয়ে যাওয়াতে আমেরিকান বাহিনী জঙ্গল অভিযানের সময় এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকতো,সেই রকম হাজার হাজার গুলি জঙ্গলের আগর গাছের গায়ে লেগে থাকে,যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর স্হানীয় আগর সংগ্রাহকরা সুগন্ধি আগরের খোঁজে জঙ্গলে গিয়ে দেখে যে জঙ্গলের সব আগর গাছেই কম বেশি সুগন্ধি কালো কাঠের সৃষ্টি হয়েছে! তারা এতদিন ধরে দেখে আসছিল শতশত আগর গাছ কাটলে দু’চার টাতেই শুধু সুগন্ধি কালো কাঠের সৃষ্টি হয়েছে।ভালো করে অনুসন্ধানের পর দেখলো যে আগর গাছের যে স্থানে গুলির (ধাতব পদার্থের) চিহ্ন রয়েছে সেই স্থানে কম বয়সি গাছেও সুগন্ধি কালো আগর কাঠের সৃষ্টি হয়েছে!
এর পর থেকেই আগর গাছ জন্মে এমন অঞ্চল গুলোতে লোহা/তারকাটা/পেরেক দিয়ে কৃত্রিম পদ্ধতিতে আগর উৎপাদন ছড়িয়ে পড়েছে।
লোহা/তারকাঁটা দিয়ে কালো কাঠ উৎপাদন করতে ৩ থেকে ৫ বছর সময় লাগে, সাধারণত ৫/৭ বছর বয়সের আগর গাছের গুঁড়া থেকে ডালপালা পর্যন্ত গাছের সম্পূর্ণ দেহে প্রতি দুই ইঞ্চি পরপর পেরেক/লোহা ঢুকিয়ে দিতে হবে,গাছ বা ডালের ব্যাস কত মোটা তার উপর ভিত্তি করে পেরেকের সাইজ নির্ধারণ করতে হবে এতে।
তারপর থেকে আরও অনেক নতুন নতুন পদ্ধতি বিভিন্ন সময় এসেছে আগর সেক্টরে,যেমন CA kit, (cultivated agar kit), AGAR wid, ন্যানো টেকনোলজি, বায় ইনকোলেশন,বা তাদের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা।
ca kit,agar wid এখন প্রায় সব আগর গাছ অধ্যুষিত অঞ্চলেই পরিত্যক্ত/বাতিল পদ্ধতি হিসাবে পরিগণিত।
ন্যানো টেকনোলজিও মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া সহ অনেক অঞ্চলে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে অসফল বা ব্যর্থ,সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও ন্যানো টেকনোলজির নামে সরকারের ৬৭ কোটি টাকা তচনছ/অপচয় হয়েছে বলে খবর রয়েছে , যদিও আমি সে বিষয়ে আগেই কতৃপক্ষের কর্তা ব্যক্তিদের জানিয়েছিলাম/সাবধান করে ছিলাম* যে ন্যানো টেকনোলজির এ প্রজেক্ট বিভিন্ন কারনে ব্যর্থ হবে!
এর মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ ও বহুল ব্যবহৃত সফল পদ্ধতি হলো বায় ইনকোলেশন,তারও শত শত ব্যবহারিক ভিন্ন ভিন্ন উপ-পদ্ধতি রয়েছে।
লোহা/তারকাটা পদ্ধতির ছেয়ে বায় ইনকোলেশন পদ্ধতিতে সুগন্ধি কালো আগর কাঠ ও তৈলের উৎপাদন কয়েক গুন বেশি হয়! খরচও কম! সময়ও অনেক কম লাগে এবং উৎপাদিত সুগন্ধি কাঠে ও তৈলে লোহা/তারকাটা পদ্ধতির মত আয়রন অক্সাইডের সংমিশ্রণের কোন সম্ভাবনা থাকেনা।
বায়ু ইনকোলেশনের প্রায় সব পদ্ধতিই নিরাপদ ও
সাশ্রয়ী,মালয়েশিয়া,ইন্দোনেশিয়া,লাওস,কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড,ভিয়েতনামে এ পদ্ধতিতে ৬/৮মাসেই যে কোন বয়সের আগর গাছেই সুগন্ধি যুক্ত কালো আগর কাঠ উৎপাদন করা হচ্ছে বহুদিন ধরে। মিয়ানমার, এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী আসাম ত্রিপুরাতেও সম্প্রতি সফলতা পেয়েছে জৈবিক প্রক্রিয়ার এ বায় ইনকোলেশন পদ্ধতি! সেখানে বিদেশি আগর বিশেষজ্ঞদের কারিগরিক সহায়তায় সরকারি ব্যবস্হাপনায় বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে ‘আগর গাছের বায় ভেকসিন’!
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় বায় ইনকোলেশন পদ্ধতি অনান্য পদ্ধতি থেকে অনেক বেশি নিরাপদ, ফলপ্রসূ ও লাভজনক! আমি নিজেই এ বায় ইনকোলেশনের ভেকসিন তৈরি করি,বিদেশে এ কাজের সাথে দীর্ঘদিন জড়িত ছিলাম।
আপসোসের বিষয় বহু দিন ধরে আমি নিজে বিদেশে আগরের ‘বায় ইনকোলেশন’ নিয়ে কাজ করলেও বাংলাদেশের বন বিভাগের মাননীয় কর্তাদের কে বায় ইনকোলেশন বিষয়ে বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি/তারা বুঝতে চায়নি বা আগ্রহী করাতে পারিনি!!!
BFRI এর কর্মকর্তারা দেখিয়ে দেন মন্ত্রণালয়, আমার হাত তো আর অতদূর পর্যন্ত প্রশস্ত করার মত বড় নয়!
বায়ু ইনকোলেশন কিভাবে কাজ করে?:–
এ বিষয়টা বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে আগর গাছে কিভাবে সুগন্ধি কাঠ সৃষ্টি হয়।
আগেই উল্লেখ করেছি আগর গাছের কান্ড বা কাঠ নরম ও সাদা, সেই সাদা কাঠের যে কোন স্থানে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যে কোন ভাবে ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটলে আগর গাছ তার নিজের প্রতিরক্ষার জন্য নিজে থেকেই এক প্রকার রস বা RESIN উৎপাদন করে সেই ছত্রাক আক্রান্ত স্থানের চারপাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, যাতে ছত্রাক গাছটির পুরো দেহে ছড়িয়ে পড়তে না পারে,কালক্রমে সে রস বা RESIN সাদা কাঠের সাথে জমাট বেঁধে কালো রং ধারণ করে সুগন্ধিতে রুপান্তরিত হয়।
সাধারণত আগর গাছের বয়স ৩ বছর হলে প্রথম ফুল আসে,তখন একটি আগর গাছ মাঝারি আকারের বাঁশের মত মোটা হয়। তিন বছর বয়স থেকে শতাধিক বছর বয়সের/যেকোন বয়সের আগর গাছে সিম্ফল কিছু নিয়ম-কানুন মেনে বায় ভেকসিন প্রয়োগ করা যায়। ভেকসিন প্রয়োগের এক মাসের ভিতর গাছে ছত্রাকে সংক্রমণের লক্ষণ প্রকাশ পায়,আবহাওয়া অঞ্চল ও মাটির প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে পরবর্তী ৪/৬ মাসের ভিতর কালো আগর কাঠ আহরণের উপযুক্ত হয়,তবে ভেকসিন প্রয়োগের এক বছর পর কালো কাঠ সংগ্রহ করলে উত্তম মানের কালো সুগন্ধি কাঠ পাওয়া যায়। টোটাল বিষয়টাও আবার কৃত্রিম ভাবে ঝিনুকে মুক্তা চাষ করার মতন ব্যপার।
বুঝিয়ে বলছি:—
একটা প্রাকৃতিক মুক্তা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি দামি চাষের মুক্তার চেয়ে,কিন্তুু একটা প্রাকৃতিক মুক্তা খুঁজে পেতে হাজার হাজার ঝিনুক ধ্বংস করতে হয়। তাই নিদিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে কৃত্রিম ভাবে ১০০ টি ঝিনুকে সিলিকন ঢুকিয়ে দিলে কিছু দিন পর দেখা যায়,প্রায় ৯৫% ঝিনুকেই মুক্তা তৈরি হয়েছে,হয়তো সব ঝিনুকের মুক্তার মান ভালো নয়/সমান নয়,হয়তো ৫০% ভাল মানের আর ৫০% খারাপ মানের,তবে সব কয়টি মুক্তারই কমবেশি আর্থিক মূল্য আছে।
তেমনি কৃত্রিম পদ্ধতিতে আগর গাছে সুগন্ধি কালো কাঠ তৈরি করলেও একই ব্যপার ঘটে!!
এতক্ষণ তো বর্ণনা ও সম্ভাবনার কথা আলোচনা করা হলো,এ পর্যায়ে এ সেক্টরের বড় সমস্যা গুলোর মধ্যে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলোচনা করবো:–
আর তা হলো সরকারী মালিকানাধীন গাছের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা,এবং ব্যক্তি মালিকানায় আগর গাছের সংকট ও আগর গাছ সম্পর্কে সঠিক অভিজ্ঞতার অভাব!
আমার জানামতে, বাংলাদেশে আগর নিয়ে সরকারি ভাবে (বন বিভাগের মাধ্যমে) ভাবনা শুরু হয় শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম টার্মে ৯৬ সালের দিকে, তখন পার্বত্য এলাকা,চট্টগ্রাম, সিলেট অঞ্চলের কিছু জায়গায় সীমিত পরিসরে সামাজিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অল্প কিছু বাগান সৃজন করা হয়,তারপর ২০১৪ সালে সরকারে এসে মাননীয় নেত্রী আগর নিয়ে আরও বেশি কাজ করা শুরু করেন,তখন দেশের মন্ত্রী পরিষদে আগর নিয়ে প্রথমবারের মতো নীতিমালা তৈরি করা হয়! এতে এ অর্থকরি বনজদ্রব্যটি নিয়ে ব্যক্তি/বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবসা,চাষ,সম্প্রসারণ, পরিবহন, রপ্তানি, গবেষনার সুযোগ আসে ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরও আগর বাগান সৃজন করা হয় বনবিভাগের জায়গায় স্থানীয় জনসাধারনকে উপকার ভোগী হিসাবে সাথে নিয়ে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে।
বনবিভাগের বক্তব্য অনুযায়ী জানা যায় বর্তমানে বাংলাদেশে তিন কোটি মত আগর গাছ আছে, বাস্তবতা এই যে কাজীর গরু কিতাবের লেখায় আছে,হিসাবের গোয়ালে নেই! কারণ লাগানোর সময় ঠিকই হয়তো তিন কোটি আগর চারা’ই সারা দেশে লাগানো হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে ১০% এর বেশি আগর গাছ আছে বলে আমার পর্যবেক্ষণে মনে হয় না,আমি নিজে আগর নিয়ে দেশের অনেক জায়গায় সরকারী বাগান সরেজমিনে ভিজিট করে আমার এ উপলব্ধি হয়েছে।
স্থায়ী উপকার ভোগীদের সাথে আলাপ করে জানতে পারি তারা নিজেরাই অনেক আগর গাছ কেটে/উপড়িয়ে নষ্ট করেছে কারণ আগর গাছ থেকে তাদের কোন ইনকাম হচ্ছে না আর যে আশায় তারা আগর বাগানের উপকার ভোগী হিসাবে নিবন্ধিত হয়েছিল সেই কাঙ্ক্ষিত লাভ তারা পাবে এমন সম্ভাবনাও তারা নিকট ভবিষ্যতে দেখছে না।
(না দেখার কারন? *১ এ দেখুন)
তার থেকে ভালো এই যে তাদের নামে উপকার ভোগী হিসাবে বরাদ্ধ করা প্লটে তারা অন্যান্য ফল ফসল আবাদ করে সহজেই লাভবান হতে পারে। আর এই সহজ পথটি বাস্তবায়নে তাদের প্রতিবন্ধকতা
সৃষ্টিকারি আগর গাছ গুলো আগে ধ্বংস করতে হবে কৌশল খাটিয়ে, তার অংশ হিসাবে আজ একটি কাল দুটি এভাবে করে মূল উপড়িয়ে বা গুঁড়া কেটে/আগুনে পুড়িয়ে,মাটি সরিয়ে আগর বাগানের এমন অবস্থা করেছে যে উদাহরণ সরূপ ৫০০টি আগর গাছের বাগানে বর্তমানে ৫০টিরও কম আগর গাছ মরতে মরতে কোন রকম বেঁচে আছে,আর ওরা সেই বাগানে মহাসমারোহে বিভিন্ন ফসলের চাষ করছে,কারণ তারা তো সেই বাগানের লাইসেন্স ধারি উপকার ভোগী! বন বিভাগের স্থানীয় কর্মচারীরা ক্ষেত্রবিশেষে মাসিক/বাৎসরিক কিছু টাকা নিয়ে খুশি থেকে,দেখেও না দেখার ভান করেন! আর এভাবেই মহামূল্যবান আগর বাগান ধ্বংসের কাজ সুকৌশলে মহাসমারোহে এগিয়ে চলছে!!!
এক এলাকায় দেখলাম, প্রায় ৫০ বিঘা জমির একটা প্লট,তাতে হাতে গোনা কয়েকটি আগর গাছ,নিচে আনারাস সহ অন্যান্য বাগান,কৌতূহলবসত আগর গাছ দেখতে প্লটে ঢুকতেই খালের উপর সাকু পার হতে গিয়ে দেখি, মোটা মোটা আগর গাছ কেঁটে সাকুতে ব্যবহার করা হয়েছে!
বিস্ময়ে আমি স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করতেই তারা বললো,আগর গাছ কোন কাজের না,লাকড়ি হিসাবেও ব্যবহার করেছি ভাল জ্বলেও না,শুধু ধোঁয়া হয়!!
এই হচ্ছে আমার অতি পূজনীয় বাংলাদেশের আগর গাছের সরকারী বাগানের বাস্তব চিত্র!!!
সেকুলাস,”সরকার কা মাল,দরিয়া মে ঢাল”।
(*১) এর ব্যাখ্যা:- বন বিভাগের সামাজিক অংশীদারিত্বের প্লটের সাথে জড়িত হওয়ার সময় সবাই এমন একটি ধারনা পেয়েছিলেন যে আগর গাছ মহামূল্যবান একটি গাছ যা লাগালেই দশ বছরে কোটিপতি! পরে তারা দেখলো যে তাদের আগে যারা যারা আগর বাগানের সাথে জড়িত হয়েছিল, তারা কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছে,বলা যায় উল্টো ফেঁসে গেছে,আগর গাছ তাদের জন্য এখন গলার কাঁটা অর্থাৎ বন বিভাগের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে আগর গাছ নিলাম/কর্তন করা হচ্ছে না। বন বিভাগের লোকজন বলছে আগর গাছের বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত পাচ্ছে না,আর উচ্চ পর্যায়ের লোকজন বলে তারা আগর সঞ্চায়ন/প্রসেসিংয়ের জন্য সাস্টেইনেবল কোন পদ্ধতি পাচ্ছেনা,তাই আগর গাছ নিলাম বা তার থেকে লাভবান হওয়ার চেষ্টা সফল হচ্ছে না,তবে তারা এও বলছে যে “বনগবেষনাগার চট্টগ্রামে” ইনকোলেশন পদ্ধতি উদ্ভাবনে চেষ্টা চলছে, ইতিমধ্যে আয়রন সলিউশন ও ন্যানোটেকনোলজির মত পদ্ধতির ইনকোলেশন চেষ্টা সফল হয় নাই বলে আপসোস করছে!(অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক আগেই এ পদ্ধতি পরিত্যক্ত ঘোষিত!)। সরকারের কাছে আরও গবেষণার জন্যে বাজেট চাওয়া হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি….
এখন শুধুই অপেক্ষার পালা! হয়তো অনন্তকাল ব্যাপি অপেক্ষা করতে হবে, অন্তত বন বিভাগের আগর বাগানের উপকার ভোগীদের চোখে এমনটাই দেখা যাচ্ছে, যারা ৯৬/৯৮ সালের দিকে প্রথম আগর বাগানে উপকার ভোগী হিসাবে প্লট পেয়েছিল তারাও এখনো কোন প্রকার লাভবান হতে পারেনি, উল্টো তাদের অনেক টাকা/শ্রম ঘাটে ঘটে ব্যয় হয়েছে, (যদিও প্রকল্পটি তে উপকার ভোগী হিসাবে তালিকা ভুক্তির বিষয়টা ছিলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে,তবে তলে তলে জল মিশেছে…) এমনটা দেখে তুলনামূলক নতুন যারা আগর প্লট পেয়েছে তাদের স্বপ্ন পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে!
তাই তারা বিভিন্নভাবে আগর বাগান ধ্বংস করার খেলায় মেতেছে!!
আমি নিজে বন বিভাগের কর্তা পর্যায়ে “বায় ইনকোলেশন” ব্যবহার করে আগর সঞ্চায়ন করার বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে অনুরোধ করেছিলাম,বায় ইনোকুলেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে সুগন্ধি কালো আগর কাঠ সৃষ্টির ব্যাপারটি যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফলতার সাথে কাজে লাগাচ্ছে,তারা নিজেরাও বিষয়টি ভালোভাবেই জানে।
কিন্তু……..?
বিদেশে আগর নিয়ে কাজ করার সুবাদে বন বিভাগের অনেক কর্মকর্তার সাথে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল ও আছে,কিন্তু তাঁদের হাত যেন কিসের শিকলে বাঁধা…..?
চলুন একটি “ইশপের গল্প” বলে এত দীর্ঘ আলোচনা জবনিকা টানি:-
[একলোক বন্দুক হাতে শিকারী ভেষে প্রতিদিন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়,কোনদিন কোন শিকার করতে তাকে দেখা যায় না,সেই জঙ্গলে এক কাঠুরিয়াও প্রতিদিন কাঠ কাটতে যায়,একদিন কাঠুরিয়া সাহস করে শিকারী কে প্রশ্ন করলো যে,প্রতিদিন আপনি বনে ঘুরে বেড়ান আপনার আসল কাজটা কি? শিকারি জবাব দেয়,বোকা কাঠুরিয়া তুমি দেখো না আমার হাতে বন্দুক আমি একজন শিকারী,ভালুক শিকার করি,ভালুকের খোঁজে সারা বন ঘুরে বেড়াই,কিন্তুু ভালুক খুঁজে পাইনা।
কাঠুরিয়া বলে আমি এ বনের সবজায়গাই ভাল ভাবে চিনি, আমি আপনাকে ভালুকের আস্তানায় নিয়ে যাবো,যত ইচ্ছা ভালুক শিকার করতে পারবেন।
শিকারী ভয়ে জরু সরু হয়ে বলে আমার ভালুকের আস্তানা যাওয়ার আর ভালুক শিকার করার দরকার নাই,আমি জঙ্গলে বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়াই এই কারণে যে মানুষ আমাকে ভালুক শিকারী বলুক,বাস্তবের ভালুক শিকার আমার কাজ না”।]
অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় আমাদের বন বিভাগ/মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের অবস্থাও সেই ভালুক শিকারীর মতন,আগর গাছে সুগন্ধি আগর সৃষ্টি হউক বা না হউক তাতে তাঁদের কিছু যায় আসেনা, তাঁরা চায় শুধুই বাজেট!
মাফ করবেন, সমালোচনা নয় উদাহরণ দিচ্ছি, ২০২২ সালের শেষের দিকে,বন মন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর উপস্হিতিতে,মৌলভীবাজারের বড়লেখায়,বন বিভাগ কতৃক ন্যানো টেকনোলোজির প্রথম লঞ্চিং উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমি নিজেও আমন্ত্রিত ছিলাম।
গিয়ে দেখি গানের চেয়েও বাজনা বেশি…..!
সারাদেশে ব্যক্তিগত মালিকানায় বর্তমানে খুব বেশি একটা আগর গাছ নেই, তবুও যা কিছুটা আছে তা হলো মৌলভীবাজারের বড়লেখা সুজানগর জুরি ছাড়াও সিলেট সদর জকিগন্জে*। এ অঞ্চলের আগর আতর ব্যবসায়িরা মূলতঃ আসাম অঞ্চলের আগর আতর ব্যবসায়িদের বংশধর,মোগল রাজদরবারে এরা আগর আতর সরবরাহ করতেন, বংশ পরম্পরায় এরা সুগন্ধি আগর আতর ব্যবসা ও প্রক্রিয়াকরণের সাথে অদ্যবধি জড়িত! প্রসংগতঃ আমার বংশের পূর্বপুরুষরাও ত্রিপুরা রাজ্যের এক সময়ের শাসক হিসাবে আগরের সাথে জড়িত ছিলেন…..।
সুজানগরের আগর আতর প্রক্রিয়াকরণ সিষ্টেম টা সেই প্রাচীন মান্ধাতার আমলের,এরা আধুনিকতার ধার ধারে না,বায়ু ইনকোলেশনের বিষয়ে এরা একেবারেই আগ্রহী না,কারণ–“চুন খেয়ে গাল পুড়েছে,তাই দই দেখলেই ডরাই “,
বিষয়টা খোলাসা করে বলি,আজ থেকে ১৫/২০ বছর আগে শ্রীলংকা থেকে CA kit ও AGAR wide নামে কেমিক্যাল নির্ভর একটা ভেকসিন জনৈক লোক আমদানি করে ঐ এলাকার আগর গাছে প্রয়োগ করে,তাতে আগর গাছে সুগন্ধি আতর তৈরির পরিবর্তে গাছ গুলোই পঁচে মরে যায়!
কেমিক্যাল নির্ভর ঐ সব ভেকসিন শ্রীলংকা সহ আগর গাছের পপুলেশন আছে এমন দেশ সমূহে অনেক আগেই ব্যবহার বন্ধ করে দেয়,কারণ এসব ভেকসিন প্রয়োগে প্রচুর সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়,একটু এদিক সেদিক হলেই গাছ পঁচে যায়,আবহাওয়ার বিষয়টাও তাতে গুরত্বপূর্ণ ভাবে খেয়াল রাখতে হয়। আরও বড় কথা হলো কেমিক্যাল নির্ভর ঐসব ভেকসিন দিয়ে উৎপাদিত সুগন্ধি আগর কাঠ ও তৈলে খারাপ রাসায়নিকের অস্তিত্ব রয়ে যায়।
সুজানগর ক্লাস্টারের আগর আতর ব্যবসায়িরা যেহেতু বংশ পরম্পরায় পারিবারিকভাবে এ ব্যবসার সাথে জড়িত তাই তারা চায় না এদের গন্ডীর বাহিরে এ ব্যবসা সম্প্রসারণ হউক!
এ অঞ্চলে কিছু লোক কিছু দিন পর পর দুই এক বোতল আগর আতর বা কিছু কালো আগর চিপস নিয়ে দুবাই সৌদি চলে যায় টুরিস্ট বা ওমরা ভিসায়, রথ দেখা ও কলা বেচার প্রথা অবলম্বন করে এরা ব্যবসা করে। অন্য লোকজন এ ব্যবসায় আসলে প্রতিযোগিতা হবে এতে তাদের ভয়!!!
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেও ব্যক্তি মালিকানায় কিছু গাছ আছে যার বেশির ভাগ উপজাতিয় লোক জনের,
গাজীপুরের নুহাশ পল্লী, ক্যাডেট কলেজ সহ ময়মনসিংহেও ব্যক্তি মালিকানায় কিছু আগর গাছ আছে,অবশ্য তারা ব্যবসায়িক ভাবে কৃত্রিম পদ্ধতিতে কিছু করতে আগ্রহী নয়,তাদের বক্তব্য হলো এ আগর গাছ অনেক বছর পর হলেও প্রাকৃতিকভাবেই সুগন্ধি আগর সঞ্চার হবে/হলেই তারা খুশি।
ব্যবসায়িকভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগর বাগান করতে হলে অনেক জায়গার প্রয়োজন,কিন্তু আমাদের দেশে কোথায় এতো ব্যক্তিগত জায়গা যে আগর গাছের বাগান করবো!
বনবিভাগের জায়গা লিজ নিয়ে করা যায়,কিন্তুু ঐ যে বুরোক্রাসি’ই সবচেয়ে বড় বাঁধা,হাসেম-কাসেম আর কাসেম-হাসেম! কিন্তু আজ বিশ্বে আগর উৎপাদন ও রপ্তানিতে শীর্ষে অবস্থানকারি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়া লাওস ভিয়েতনাম মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া’য় সরকারি ভাবে আগর চাষের জন্য পামওয়েল বাগান ধ্বংস করে দীর্ঘ মেয়াদি জায়গা বরাদ্দ দিচ্ছে,সহজ শর্তে ব্যাংক লোন দিচ্ছে!
আমি দীর্ঘ দিন বিদেশে এ সেক্টরে থেকে,দেশে ফিরে সুগন্ধি আগর রিলেটেড কিছু করার প্রয়াসে,অনেক আশা নিয়ে ছোট একটা প্রতিষ্ঠান গড়েছি :—
AGARWOOD AGRO FARMING নামে,কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় দীর্ঘ মেয়াদি জমি লিজ/ভাড়া পাওয়ার জন্য বনবিভাগ,বিমানবাহিনী সহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুরে ঘুরে কয়েক জোড়া জুতা ক্ষয় করা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি,পরে ব্যক্তি পর্যায়ের অল্প কিছু জমি দিয়ে শুরু করলেও নানান সীমাবদ্ধতায় দিশেহারা!
কয়েকটি ব্যাংকে ধরনা দিয়েও বিফল হয়েছি,তাদের ভাষ্য হলো আমরা “প্লান্টেশন খাতে টাকা লোন দেইনা”
আর “আগর” কি জিনিস আমরা চিনি না! এ হলো অবস্হা!!
এ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে আগর নিয়ে আমি যে সম্ভাবনা দেখছি:-
ধরে নিলাম বন বিভাগ গোল্লায় গেছে,তাদের হিসাব মতে তাদের লাগানো তিন কোটি আগর গাছের ভিতর, আমার হিসাব মত কম বেশি ২০/৩০ লাখ আগর গাছ নিয়ে বনবিভাগ বাজেট ও পরিকল্পনার খেলা অনন্তকাল ব্যাপি খেলতে থাকুক।
কিন্তু সারাদেশের হাজার হাজার সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খালি জায়গায় (বরিশাল বিভাগ ও প্লাবন ভূমির/বন্যায় প্লাবিত হয় এমন উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো ব্যতিত,কারন আগর গাছের গুড়ায় দীর্ঘদিন/কিছুদিন পানি জমে থাকলে আগর গাছ মরে যায়) অংশীদারিত্বে ভিত্তিতে কোটি কোটি আগর গাছ লাগানো যায়। এ গাছের পাতা গরু ছাগলেও খায় না,পোকামাকড়েরও উপদ্রব কম,সারেরও তেমন প্রয়োজন নেই,তাই বাড়তি নজর দারির প্রয়োজনও নেই।
এতে সকল পক্ষ যেমন লাভবান হবে তেমনিভাবে দেশও লাভবান হতে পারে ব্যাপকভাবে,এ নিয়ে আমার একটা ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ/গবেষণাও আছে*।
আগর গাছ দেখতেও দৃষ্টি নন্দন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো ছাড়াও মসজিদ,মুক্তব, মাজার,মন্দিরের মত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলোর উন্মুক্ত জায়গায় আগর গাছ লাগানোর ভালো সম্ভাব্য ক্ষেত্র! থাইল্যান্ডে এভাবে করা হয়েছে।
এ গাছের ডালপালা কম,সোজা হয়ে খাড়া ভাবে উপরে উঠে যায়,তাই শহর অঞ্চলের রোড ডিভাইডারে অনায়াসেই আগর গাছ লাগানো যায়। আগর গাছ যেহেতু খরা সহিষ্ণু,রোড ডিভাইডারের ইট/কাঁকর যুক্ত স্থানে সে দিব্বি বেড়ে উঠবে/বেঁচে থাকবে। ১০০% রপ্তানিমুখি আগর ও আগর পণ্য দেশের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উত্তম ও স্থায়ী হাতিয়ার হতে পারে….!!!
দেশের রেলপথ সমূহের দু’ধারেও আগর গাছ লাগানো যায় সুন্দর ও সফল ভাবে*।
উপরোক্ত আলোচনা সমূহের শেষে সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ে আমার আবেদন এই যে, এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আগ্রহী হলে আমি আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা উজাড় করে দিতে রাজি আছি…।
অনেকে সঠিক তথ্য না জেনে বলেন যে,আগর গাছ পাহাড়ি অঞ্চলের গাছ,পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি ছাড়া এ গাছ জন্মে না…..ইত্যাদি ইত্যাদি,
আসল তথ্য হলো, আবহাওয়া অনুকূল থাকলে সব ধরনের মাটিতেই আগর গাছ জন্মে,তবে সব সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন গাছের গুড়ার মাটিতে পানি জমে না থাকে,অল্প কিছু দিনও যদি পানি জমে থাকে বা মাটি বেশি সেঁতসেঁত থাকে তবে আগর গাছের গুড়া/শিকড় পঁচে গাছ মারা যাবে।
আরেক টা বিষয় হলো কাঁকর/পাথর যুক্ত পাহাড়ি অঞ্চলের মাটিতে প্রাকৃতিক ভাবেই সুগন্ধি কালো আগর কাঠ সৃষ্টির সম্ভাবনা সর্বাধিক থাকে, অন্য দিকে সমতলের মাটিতে কৃত্রিম পদ্ধতি ছাড়া সুগন্ধি কালো আগর কাঠ সৃষ্টি প্রায় অসম্ভব।
গার্মেন্টস সেক্টরের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সাথে,আগর সেক্টরের সম্ভাব্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তুলনা:–
আমি এক সমীক্ষায় দেখেছি,গত বছর এ দেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি বিদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিল প্রায় ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ।
একটু ভেবে দেখুন তো এইযে ৩৫ বিলিয়ন ডলার তার থেকে দেশ নীট মুনাফা করেছিল কত?
হয়তো আপনি ভাবছেন রপ্তানি আয় সবইতো দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়। আমি বলি না,বাস্তবতা কিন্তু অন্য!
এই ৩৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মাল তৈরি করতে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়েছে কত বিলিয়ন ডলারের?
বিদেশি এক্সপার্টরা ও বিদেশি বিনিয়োগকারিরা কত বিলিয়ন ডলার তাদের দেশে নিয়ে গেল রেমিট্যান্স হিসাবে?
গার্মেন্টস গুলো তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য কত বিলিয়ন ডলারের যন্ত্রাংশ আমদানি করলো?
কত ডলারের এক্সেসরিজ আমদানি করলো?
সব হিসাব করে দেখলে আপনি এটাই পাবেন যে,মজুরি ও টেক্স সহ আমাদের দেশীয় গার্মেন্টস মালিকদের আয় মিলে দেশের নীট আয় কম বেশি ১০%এর ভিতরই থাকে। অর্থাৎ ৩/৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছিই থাকে বছরে।
প্রবন্ধের শুরুতেই আমি দেখিয়েছি,বাংলাদেশ যদি পরিকল্পিতভাবে আগর পণ্য নিয়ে বিশ্ব বাজারে যায়,তবে বছরে ৩/৪ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে অনায়াসেই এবং এ পণ্য তৈরি করতে বিদেশ থেকে প্রায় কিছুই আমদানি করতে হবে না। তার মানে আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রার সবটাই দেশের নীট আয়। যা গার্মেন্টস সেক্টরের নীট আয় কৃত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় সমপরিমাণ!!!
আরও একটা বিষয় এইযে,গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি গুলো প্রায় সব গুলোই শহর এলাকায়,আর আগর রিলেটেড শিল্প/ব্যবসা গুলো গ্রাম এলাকায় সহজেই করা যাবে বা করতে হবে,দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে। এতে বাড়িতে বসে গ্রামের মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে,শহরমুখিতা কমবে গ্রামের উন্নয়ন হবে…!
আর এই কোটি কোটি আগর গাছ থেকে পরিবেশের কি পরিমাণ লাভ হবে,তার আর্থিক মূল্যই বা কত? তা একবার ভেবে দেখুন!!!
অন্য দিকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া পরিবেশের জন্য বিপদজনক বিদেশি জাতের ইউক্যালিপটার, একাশিয়ার মত অনেক গাছের প্রজাতি আমাদের প্রতিবেশের জন্য কতটা হুমকি তা অভিজ্ঞ মহলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে! এমতবস্থায় আমাদের এ অঞ্চলের আদি বৃক্ষ “আগর গাছ” দিয়ে এটার মোকাবেলা করা সম্ভব।
সুগন্ধি আগর গাছ অর্থনৈতিক ভাবে কতটা লাভজনক এ বিষয়ে আরও জানতে আগ্রহি হলে নিম্নে “ব্র্যাক টি এস্টেটের ” গবেষণা পেপার’টি দেখে নিতে পারেন :–
(PDF) Agarwood Plantation at BRAC Tea Estate
মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান
উদ্যোক্তা ও আগর বিশেষজ্ঞ